মো: রিয়াজ স্টাফ রিপোর্টার
শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে নিখোঁজের দুই দিন পর মাত্র ১০ বছরের এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত শিশুটির নাম ইলিয়াস। শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে উপজেলার গান্ধিগাঁও কালীস্থান সংলগ্ন কালঘোষা নদী থেকে তার মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নাজমুল নামে স্থানীয় এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহত ইলিয়াস উপজেলার গান্ধিগাঁও গ্রামের কালু গাজীর ছেলে। সে স্থানীয় একটি ব্র্যাক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী ও প্রাণবন্ত শিশু হিসেবে এলাকার সবাই তাকে চিনত। বুধবার ভোরে হঠাৎ করেই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। দিনভর অপেক্ষা ও উদ্বেগের পরও কোনো সুরাহা না হওয়ায় পরদিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়।
শুক্রবার গভীর রাতে স্থানীয়রা নদীর পানিতে একটি মরদেহ ভেসে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে। মরদেহ উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। বাবা মায়ের বুকফাটা কান্নায় উপস্থিত মানুষজনও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
নিহতের পরিবার অভিযোগ করে জানায়, ইলিয়াসকে হত্যার পর মরদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাদের বিশ্বাস, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। স্বজনদের দাবি, নিহত শিশুর শরীরে স্পষ্ট আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাদের ধারণা, কোনো না কোনো কারণে শিশুটিকে নির্যাতন করা হয় এবং পরে নির্মমভাবে হত্যা করে গুম করার চেষ্টা চালানো হয়।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে, ইলিয়াস নাজমুল নামে এক যুবকের মুরগির খামারে গিয়েছিল। সেখানে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে তার মৃত্যু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মৃত্যুর পর মরদেহ গোপন করার উদ্দেশ্যে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় বলে পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ।
ঝিনাইগাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আল আমিন বলেন, “আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করি এবং ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। সন্দেহভাজন নাজমুলকে আটক করা হয়েছে। ডাক্তারি প্রতিবেদন পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাজমুল দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় মুরগির খামার চালিয়ে আসছে। তবে তার বিরুদ্ধে অতীতে নানা ধরনের অভিযোগ ছিল। এলাকায় মিশুক স্বভাবের হলেও অনেক সময় তাকে সন্দেহজনক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। ইলিয়াসের মৃত্যুতে তাকে দায়ী করে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আটক নাজমুলের কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন তারা।
ঘটনার পর থেকেই গান্ধিগাঁও গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের আবহ। প্রতিবেশীরা বলছেন, এমন নিষ্ঠুর মৃত্যু মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন। মাত্র ১০ বছরের একটি প্রাণ, যে এখনও স্বপ্নের ডানা মেলতে পারেনি, তাকে এমনভাবে হারাতে হবে,এটা কেউ কল্পনাও করেনি। শিশু ইলিয়াসের স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীরাও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ইলিয়াস ক্লাসে খুব মনোযোগী ও ভদ্র আচরণের জন্য সবার প্রিয় ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে বিদ্যালয়ের পরিবেশেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
এই ঘটনার পর অভিভাবক মহলেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার মানুষ বলছেন, দিনের আলোতে বা ভোরবেলায় একটি শিশু ঘর থেকে বের হয়ে আর জীবিত ফিরে আসবে না, এমন ঘটনা সমাজের জন্য বড় হুঁশিয়ারি। তারা মনে করেন, শিশুদের নিরাপত্তায় এখন আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিও তারা নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, শিশুটির মৃত্যুর কারণ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, ঘটনাটি হয়তো কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য থাকতে পারে। বিশেষ করে শরীরে পাওয়া আঘাতের চিহ্নগুলোকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে সন্দেহ বাড়ছে। এলাকাবাসীর দাবি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে হবে।
নিহতের পরিবার জানিয়েছে, ইলিয়াসের মৃত্যুর ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত তারা শান্ত হবেন না। শিশুটির মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন এবং বলছেন, “আমার ছেলেকে কেড়ে নিল তারা, আমি বিচার চাই।” বাবাও অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে একই দাবি জানিয়েছেন।
ঘটনার পর শেরপুর জেলায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের ডাক উঠেছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন বলছে, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।
ঝিনাইগাতীতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি নতুন করে শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রশাসন জানিয়েছে, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মাত্র ১০ বছরের একটি শিশুর অকাল মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো এলাকার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। গান্ধিগাঁওয়ের মানুষ হয়তো অনেক দিন ধরে এই ঘটনার শোক বহন করবে। তবে তারা আশা করছেন, ইলিয়াস হত্যার প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হবে এবং দোষীরা শাস্তি পাবে।